Sunday, September 14, 2025
Homeজাতীয়অপরাধপেশা জুয়া, নেশা বাড়ি কেনা

পেশা জুয়া, নেশা বাড়ি কেনা

ক্যাসিনো কারবারি দুই ভাই এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়া গত ৬ বছরে পুরান ঢাকায় বাড়ি কিনেছেন কমপক্ষে ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ৬টি। পুরোনো বাড়িসহ কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ইমারত। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এই দুই ভাইয়ের মূল পেশা জুয়া আর নেশা হলো বাড়ি কেনা।

জুয়ার টাকায় তাঁরা কেবল বাড়ি ও ফ্ল্যাটই কেনেননি, ক্ষমতাসীন দলের পদও কিনেছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে গত বছর এনামুল হক পেয়েছেন গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ আর রূপন ভূঁইয়া পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। তাঁদের পরিবারের ৫ সদস্য, ঘনিষ্ঠজনসহ মোট ১৭ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে পদ পেয়েছেন। তাঁরা সরকারি দলের এসব পদ-পদবি জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার নির্বিঘ্নে চালানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

রেজিস্ট্রি অফিস ও এলাকায় অনুসন্ধান করে এনামুল-রূপনের ১২টি বাড়ি, ৬টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা গত ছয় বছরে কিনেছেন। এর মধ্যে পুরান ঢাকার মুরগিটোলায় চারটি, লালমোহন সাহা স্ট্রিটে তিনটি ও নারিন্দা লেনে দুটি এবং গুরুদাস সরকার লেন, ভজহরী সাহা স্ট্রিট ও দক্ষিণ মুহসেন্দীতে একটি করে বাড়ি রয়েছে তাঁদের। এর বাইরে শাহ সাহেব লেন ও লালমোহন সাহা স্ট্রিটে তাঁদের ছয়টি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে।

এনামুল-রূপনের ঘনিষ্ঠজন ও স্থানীয় লোকজনের ধারণা, তাঁদের জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সংখ্যা আরও বেশি হবে। তাঁদের পুরান ঢাকায় স্টিল শিটের ব্যবসা থাকলেও আয়ের বড় উৎ​স ছিল মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে জুয়ার কারবার। কয়েক বছর আগে সেখানে তাঁরা ক্যাসিনো চালু করেন।

সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর এই দুই ভাই আলোচনায় আসেন। এরপর থেকে তাঁরা পলাতক আছেন। র‍্যাব গত ২৪ সেপ্টেম্বর এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়াদের বাসায় এবং তাঁদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে পাঁচ কোটি টাকা এবং সাড়ে সাত কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। এরপর সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়া থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়েছে। এরপর তিন সপ্তাহ পার হলেও দুই ভাই গ্রেপ্তার হননি। সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, একাধিক দিন অভিযান চালিয়েও তাঁদের ধরা যায়নি।

কোথায় কোন বাড়ি
সূত্রাপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধিত দলিল অনুযায়ী, এই দুই ভাই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৩১ নম্বর কাঠেরপুল লেনে একটা পুরোনো বাড়িসহ ২৪০ অযুতাংশ জমি কিনেছেন ইউসুফ খান হারুনের কাছ থেকে। দলিলে মূল্য লেখা হয় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, প্রকৃত মূল্য আরও বেশি হবে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো বাড়িটি ভেঙে সেখানে ছয়তলা বাড়ি বানানো হয়েছে।

২০১৬ সালে ১৫ নম্বর নারিন্দা লেনে জমিসহ পুরোনো দুটি বাড়ি শাকিল আক্তার নামের এক লোকের কাছ থেকে কিনে নেন এনামুল হক। দলিলে দাম লেখা হয় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গত রোববার সেখানে দেখা গেল, পুরোনো বাড়ি ভেঙে ওই জায়গায় বানানো হয়েছে নতুন পাঁচতলা বাড়ি।

বছর দেড়েক আগে ১ নম্বর নারিন্দা লেনে ইয়াহিয়া ভূঁইয়ার তিনতলা বাড়িটি কিনে নিয়েছেন জুয়ার কারবারি দুই ভাই। তাঁরা গত বছর ৬ নম্বর গুরুদাস সরকার লেনে পুরোনো ভবনসহ প্রায় পাঁচ কাঠা জমি কিনেছেন। দলিলে দাম লেখা হয় ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সালাউদ্দিন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, এই জমির প্রকৃত দাম ৫ কোটির কম নয়। সেখানে ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। কাজ শেষ পর্যায়ে।

৬৫/২ নারিন্দা রোডের ১০ তলা বাড়িটিও এই দুই ভাইয়ের। বাড়ির ব্যবস্থাপক আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর আগে এনামুল-রূপন এই বাড়ি বানিয়েছেন।

নারিন্দা রোডের দক্ষিণে ভজহরী সাহা স্ট্রিটের ৪৪/বি নম্বর বাড়িটি গত বছর কিনেছেন তাঁরা। পাশের বাড়ির কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আতাউর রহমান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা দিয়ে বাড়িটি কেনেন এনামুল-রূপনরা।

এনামুল-রূপনেরা সাত ভাইবোন। বাবার নাম সিরাজুল হক ভূঁইয়া। তাঁর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। পুরান ঢাকায় বিয়ে করে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন সিরাজুল হক। তিনি ১০৫ লাল মোহন সাহা স্ট্রিটে বাড়ি করেন। পাঁচতলা এই বাড়ির পেছনে ১০৩ লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের বাড়িটি ২০১৪ সালে কিনে নেন এনামুল-রূপন। দলিলে ক্রয়মূল্য দেখানো হয় ৩২ লাখ টাকা। পুরোনো বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের গলি ধরে দক্ষিণ মুহসেন্দী স্কুল পার হলে নারিন্দা কাঁচাবাজার। বাজারের উত্তর দিকের গলিতে ছয়তলা একটা ভবনের মালিক এনামুল-রূপন। বছর দুই আগে বাড়িটি কিনেছেন তাঁরা।

রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ করে জানা গেছে, এনামুল হক-রূপন ভূঁইয়া আরও ছয়টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বেশির ভাগ ফ্ল্যাট কেনা হয় ২০১৪ সালে। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জেও দুই ভাইয়ের এক বিঘা জমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁদের চাচা আমিনুল হক।

৪০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই দুই ভাই ক্যাসিনোর অবৈধ টাকায় একের পর এক বাড়ি কিনেছেন। ​এটা তাঁদের নেশায় পরিণত হয়েছে।

রাতারাতি নেতা হলেন
ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর দলীয় পদ পাওয়ার আগে এনামুল-রূপনদের মানুষ খুব একটা চিনত না। একজন গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আরেকজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়ার পর এলাকায় নিজেদের ছবি দিয়ে বড় বড় পোস্টার সাঁটিয়েছেন তাঁরা।

তাঁদের আরেক ভাই রশিদুল হক ভূঁইয়া ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রশিদুল হকের ছেলে বাতেনূর হক ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আর এনামুল-রূপনদের আরেক ভাতিজা তানিম হক ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এনামুল-রূপনরা ওপরে টাকা দিয়ে পদ কিনেছেন। পরিবারের পাঁচজন সদস্য ছাড়াও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ১২ জনকে আওয়ামী লীগে পদ পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁরা হলেন পাভেল রহমান (৪০ নম্বর ওয়ার্ড সহসভাপতি), আসলাম (৪০ নম্বর ওয়ার্ড ক্রীড়া সম্পাদক), জাহাঙ্গীর আবদুল্লাহ (৪০ নম্বর ওয়ার্ড যুগ্ম সম্পাদক), রাজ্জাক (৪০ নম্বর ওয়ার্ড বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক), হারুন (৪০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির নির্বাহী সদস্য), আফতাব উদ্দিন আহমেদ (৪১ নম্বর ওয়ার্ড সাংগঠনিক সম্পাদক), তারেক (৪১ নম্বর ওয়ার্ড কৃষিবিষয়ক সম্পাদক), রতন (ধর্মবিষয়ক সম্পাদক), মনজুরুল কাদের (সাংস্কৃতিক সম্পাদক), মিজানুর রহমান (ক্রীড়া সম্পাদক), মঞ্জু (সদস্য) ও কতুব উদ্দিন (সদস্য)।

গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনামুল, রূপনসহ তাঁদের ঘনিষ্ঠদের কেউ পদ দেয়নি। তাঁরা জায়গা করে নিয়েছেন। কীভাবে পদ পেয়েছেন সেটা বলতে পারব না।’ অবশ্য আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকার ভিত্তিতে এনামুল-রূপনরা পদ পেয়েছেন। টাকার বিনিময়ে কাউকে পদ দেওয়া হয়নি।

পলাতক থাকায় এনামুল ও রূপনের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তাঁদের বাসায় গিয়ে দরজা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের স্টিল শিটের ব্যবসা দেখাশোনা করেন চাচা আমিনুল হক। তিনি গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, এনামুল-রূপনরা কোথায় আছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, স্টিল শিটের ব্যবসায় তাঁদের মূলধন এখন ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এনামুল-রূপনরা মোট কত জমি, কত বাড়ি কিনেছেন, তা জানেন না বলে তিনি দাবি করেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা করে টাকা কামানোর সুযোগ কারও নেই। রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ গড়ার অপরাধের বিষয়টি দুদকের মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, যারা এনামুল-রূপনদের চিহ্নিত করল, তারা কেন পরবর্তী সময়ে এই দুজনকে ধরছে না, সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত। এটা জনমনে সন্দেহ তৈরি করেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments