Monday, September 15, 2025
Homeসারাদেশভোলায় সহিংসতা ঘটনা 'পরিকল্পিত' খুলছে না জট

ভোলায় সহিংসতা ঘটনা ‘পরিকল্পিত’ খুলছে না জট

ঘটনা পরিকল্পিত- ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ঘটে যাওয়া সহিংসতা নিয়ে স্থানীয় অনেকের মত এমনটাই। তবে যে বিপ্লবের ফেসবুক আইডি ব্যবহূত হয়েছে ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে এবং হ্যাকার সন্দেহে আটক শরীফ- কাউকেই তথ্যপ্রযুক্তিতে এতটা দক্ষ মনে হয়নি। এটা ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) আসনের সাংসদ আলী আজম মুকুল এবং জেলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে অভিযুক্ত বিপ্লব চন্দ্র শুভর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, যে বা যারা বিপ্লবের ফেসবুক হ্যাক করেছিল,  তারা তার কাছের কেউ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

গতকাল সোমবার সকাল ১১টায় বিপ্লবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল- উঠানে কয়েকজন নারী-পুরুষ জটলা করে আছেন। তাদের মধ্যে বিপ্লবের মা বাসন্তী রানী বৈদ্য ও বাবা চন্দ্রমোহন বৈদ্যও ছিলেন। এক আঙিনা ঘিরে পাঁচটি ঘর, যার একটিতে থাকে বিপ্লবদের পরিবার। বিপ্লবের মা-বাবার ফেসবুক নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। তবে তাদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে অন্য একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বিপ্লবের কাকা অসীম কুমার বৈদ্য। সম্পর্কে আপন কাকা হলেও অসীম আর বিপ্লব সমবয়সী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

অসীম বলেন, ‘বিপ্লব শুক্রবার সকালে মাঠে গেছিল জঙ্গল বাছা করতে (আগাছা নিড়ানি দিতে)। দুইটা বাজে মাঠ থেকে ফিরে এলে প্রতিবেশী মোশাররফের ছেলে মিজান তাকে জানায়, তুমি ফেসবুকে এইসব কী লেখালেখি করতেছ?’ অসীমের বর্ণনা অনুযায়ী, বিপ্লব তখনই জানতে পারে ঘটনাটি। বিপ্লবকে মিজান জানান, তার কাছে বিপ্লব ৬০০ টাকা ধার চেয়েছিলেন। দিতে পারবে না বলায় বিপ্লব মহানবীকে (সা.) নিয়ে গালাগালি করেছেন। বিপ্লব বিস্মিত হন। কারণ, তার মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার মতো ডাটা ছিল না। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন এবং অসীমকে সঙ্গে নিয়ে বোরহানউদ্দিন থানায় যান। থানা প্রথমে তার জিডি নিতে অস্বীকার করে। পরে থানা থেকে বেরিয়ে তারা জানতে পারেন, ঘটনা অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। তাই বাড়ি ফিরতে ভয় পেয়ে যান। পরে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আবারও থানায় গিয়ে জিডি করেন। অবশ্য এরই মধ্যে বিপ্লবের কাছে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন আসে এবং ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি দুই হাজার টাকা দিলে তার হ্যাক করা আইডি মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানায়।

বোরহানউদ্দিন থানার ওসি ম. এনামুল হক জানান, বিপ্লবের দেওয়া ওই নম্বরটি ধরে তারা পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে শরীফ নামের একজনকে আটক করে আনেন। শরীফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আটক করা হয় ইমনকে। সরেজমিনে বিপ্লবদের কাছিয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, শরীফ ও বিপ্লব প্রতিবেশী। ইমনের বাড়ি একটু দূরে। এ দু’জন পড়াশোনায় বিপ্লবের জুনিয়র হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। শরীফের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবা কাউকে পাওয়া গেল না। ঘর তালাবন্ধ। তবে পাশের ঘরে ছিলেন শরীফের চাচাতো বোন রুমা বেগম। তিনি জানান, শরীফরা দুই ভাই। বড় ভাই আরিফ থাকেন সৌদি আরবে। ওদের বাবা চাকরি করেন মালটানা জাহাজে; দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। শরীফের মা কোথায় গেছেন বলে যাননি।

রুমা বলেন, ‘চাচি অনেক ভয় পাইছে।’ শরীফের এই বোনটি ফেসবুকের কথা শুনেছেন। তবে এই সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তার মতে- শরীফেরও খুব বেশি ধারণা থাকবার কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘শরীফ গেল বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়া ফেল করেছে। কলাপাড়ায় কী একটা চাকরি করত। ওর বুদ্ধিসুদ্ধি কম।’

পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারও গতকাল দুপুরে ভোলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে স্বীকার করেছেন- শরীফের হয়তো হ্যাকিং করার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান নেই। তবে যেই-ই বিপ্লবের ফেসবুক হ্যাক করে থাকুক না কেন, যে বা যারা কাজটি করেছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানোর জন্য, এটা অত্যন্ত পরিকল্পিত। পুলিশ বিপ্লবকেও সন্দেহের আওতামুক্ত মনে করছে না। তবে কে বা কারা এটি করেছে, তা জানার জন্য সব তথ্য-উপাত্ত পুলিশের আইটি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হচ্ছে বলে জানান পুলিশ সুপার।

এর আগে গতকাল সকালে বোরহানউদ্দিন থানার ওসির কক্ষে কথা হচ্ছিল স্থানীয় সাংসদ আলী আজম মুকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, কাজটি যে পরিকল্পিত, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, কাছিয়ায় কিছু স্থানীয় বিরোধ রয়েছে। কাজেই হ্যাকার সন্দেহে যাকে আটক করা হয়েছে, তাকেও ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর অবমাননা আমরা কেউ সহ্য করব না। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারটি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। যারা না জেনেশুনে উস্কানি দিয়ে নিরীহ মানুষকে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছেন, তাদেরও বিচার করা হবে।’

স্থানীয় বিরোধের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, বিপ্লবদের প্রতিবেশী মনোহর বালার ছেলে হরিগোপাল বালার জমি কেনাবেচা নিয়ে একটা বিরোধ আইয়ুব আলীর সঙ্গে লেগেছিল কিছুদিন আগেও। হরিবালা বিপ্লবের মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন জমি বিক্রি করবেন বলে। কিন্তু তিনি টাকা নেওয়ার পর ওই জমি বিক্রি করে দেন আইয়ুবের ভাই গিয়াসউদ্দিনের কাছে। পরে অবশ্য স্থানীয় সালিশে গিয়াস তার কেনা জমিটিই বিপ্লবের মায়ের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন বলে জানালেন কাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুর রাজ্জাক। খোঁজ নিতে বাড়িতে গিয়েও আইয়ুব ও গিয়াসের কাউকে পাওয়া গেল না। আইয়ুবের ছেলে ইসমাইল জানায়, ‘চাচা লালমোহনে আছেন। বাবা গেছেন বাইরে।’ ইসমাইলের দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরেও পাওয়া গেল না তাদের। এই আইয়ুব ও গিয়াস সম্পর্কে শরীফের দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই। সেটা শরীফের চাচাতো বোন রুমা বেগমও স্বীকার করেছেন। তবে তার প্রশ্ন- ‘কেনা জমি বিপ্লবদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় আইয়ুবদের ক্ষোভ থাকতে পারে। শরীফের কেন?’ শরীফের পাড়া-প্রতিবেশী তরুণরাও বলছেন, ‘ও ফেসবুক বিষয়টা ভালো জানে না।’

সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তামজীদ রহমান লিও বলেন, ‘অন্যের ফেসবুকের অ্যাকসেস আদায় করার জন্য খুব বেশি জানার প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় ই-মেইলের পরিবর্তে মোবাইল ফোন নম্বরের মাধ্যমে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। পাসওয়ার্ড হিসেবে নিজের নাম, গ্রামের কিংবা আশপাশের কোনো কিছুর নাম ব্যবহার করা হয়। আবার ই-মেইলের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুললেও নিজের ফোন নম্বর বা এ রকম কোনো কিছু পাসওয়ার্ড হিসেবে সেট করা হয়। এ রকম হলে আশপাশের সুযোগসন্ধানীদের ফেসবুকের অ্যাকসেস নেওয়া সহজ হয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে একে হ্যাকিং না বলে অন্য কেউ ফেসবুকের অ্যাকসেস নিয়েছে বলা ভালো।’

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য বিপ্লবের সঙ্গে নিছক রসিকতা করেছিলেন বলে দাবি করেছেন শরীফ। সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র এমনটাই জানিয়েছে। সূত্রটি জানায়, শরীফের দাবি- ফেসবুকে বিপ্লবের কাণ্ড দেখে তার মনে হয়, একটু ভয় দেখাই। তাই তিনি ফোন করেছিলেন।

বোরহানউদ্দিন থানার ওসি ম. এনামুল হক জানান, শরীফ যে মোবাইল ফোন নম্বরটি ব্যবহার করে বিপ্লবের কাছে টাকা চেয়েছিলেন, সেটি শামসুন্নাহার নামের এক ভদ্রমহিলার নামে নিবন্ধন করা। শরীফ এটি সংগ্রহ করেছিল তার বন্ধু ইমনের কাছ থেকে। পুলিশ ইমনকেও আটক করেছে।

ইমনের বাড়ি গেলে ওর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ইমন ওই সিমটি ব্যবহার করত। সিমটি আমার মা শামসুন্নাহারের। ইমন সেটি বিক্রি করে দেয় শরীফের কাছে। দেড় বছর ধরে ইমনের সঙ্গে শরীফের কোনো যোগাযোগ নেই।’

বিপ্লব, শরীফ ও ইমন- এ তিনজনকেই গতকাল আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ফেসবুকে একটি বিভ্রান্তিকর পোস্ট নিয়ে সোমবার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে ‘তৌহিদী জনতা’র সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চারজন। ওই ঘটনায় আহত হন ১০ পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments