Saturday, September 13, 2025
Homeজাতীয়অপরাধঅঢেল সম্পদের ভান্ডার বিধান ভান্ডারের

অঢেল সম্পদের ভান্ডার বিধান ভান্ডারের

বিধান কুমার ভান্ডার। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি)। তার নামের অংশে ‘বিধান’ থাকলেও প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে মানেননি অনেক নিয়ম বা বিধান। নামের আরেক অংশ ‘কুমার’-এর যথার্থতা দেখিয়েছেন তিনি। বাংলা অভিধানে ‘কুমার’ শব্দের অর্থ যুবরাজ। এখন সরকারি এই সাবেক কর্মকর্তা হয়েছেন বিত্তবৈভবের ‘যুবরাজ’!

বিধান কুমারের গ্রামের বাড়ি খুলনা। সেখানেই তার সম্পদের ভান্ডার। খুলনার মুজগুন্নি আবাসিক এলাকায় রয়েছে বিধান কুমারের নামে সাত তলা ভবন। জমিসহ সেটির আনুমানিক দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। এ ছাড়াও সমকাল অনুসন্ধান চালিয়ে খুলনা নগরে তিনটি প্লটে তার ২৭ কাঠা জমির হদিস পেয়েছে। এসব জমির বর্তমান বাজারদর দেড় কোটি টাকা। পাশাপাশি চিকিৎসক ছেলের নামে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে নির্মাণ করছেন সাত তলার অত্যাধুনিক জেনারেল হাসপাতাল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, চাকরিজীবনে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়নের দায়িত্বে থেকে বিধান কুমার করেছেন নিজের পকেট উন্নয়ন। তার বিরুদ্ধে মৃত্তিকাবিষয়ক নির্দেশিকা ছাপানোয় দুর্নীতি, অবৈধ উপায়ে প্রকল্প পরিচালক হওয়া, ক্রয়নীতি না মেনে কেনাকাটায় অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সাবেক এই ডিজির নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

তিন গাড়ি বরাদ্দ :বিধান কুমার ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত ডিজির দায়িত্ব পান। গত ৩০ জানুয়ারি তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। এর পরও তিনি সরকারি একটি গাড়ি ব্যবহার করে যাচ্ছেন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। ভারপ্রাপ্ত ডিজি থাকা অবস্থায় নিয়ম না থাকলেও তিনি তিনটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-০১১৬, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-১০৪৫ এবং ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৭৮৪৬) বরাদ্দ নিয়েছিলেন। দুটি গাড়ি তার স্বজনরা ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ ছিল। চাকরি ছাড়ার পর তিনটি গাড়ি কাগজে-কলমে জমা দিলেও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৭৮৪৬ নম্বর গাড়িটিতে এখনও তিনি মাঝেমধ্যে চড়েন। ওই গাড়ির চালক জালাল বলেন, ‘বিধান স্যারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। সচিবালয়ে অফিসের গাড়ি ছাড়া ঢোকা যায় না। তাই সচিবালয়ে যাওয়ার সময় কয়েক দিন স্যারকে গাড়িতে নিয়ে গেছি।’
খুলনায় চলমান একটি প্রকল্পের গাড়ি এখনও (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৪১৩৬) ব্যবহার করছেন বিধান কুমারের চিকিৎসক ছেলে স্বপ্নীল কুমার ভান্ডার দিগন্ত। তিনি বেসরকারি খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তবে প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেন চালক শেখ মোহাম্মদ লিখন।

কেনাকাটায় অনিয়ম :২০২১ সালের জুনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নতুন ২৬টি ফিল্ড সার্ভিস অফিস এবং ল্যাবের জন্য আসবাব ও মালপত্র কেনা হয়। ঢাকার বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এসব মালপত্র কেনা হয়েছে বলে ভাউচারে দেখানো হয়। বাস্তবে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে ওই এলাকা থেকে আসবাব কেনা হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা পর্যায়ের কয়েকজন ওই সময় লিখিত প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন।
পাঁচটি কোটেশনের মাধ্যমে এককালীন তিন লাখ অথবা বছরে ১৫ লাখ টাকার মালপত্র কেনার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে গত বছর মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটে ১৯টি কোটেশনের মাধ্যমে এক কোটি ২০ লাখ টাকার মালপত্র কেনা হয়।

নির্দেশিকা ছাপাতে অনিয়ম :মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের গাইডলাইন বই বা উপজেলা নির্দেশিকা তৈরিতেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। সব সময় ঢাকা থেকে নির্দেশিকা ছাপানো হলেও বিধান কুমার ভারপ্রাপ্ত ডিজির দায়িত্ব পাওয়ার পর খুলনা থেকে তা ছাপাচ্ছিলেন। প্রকাশনা সেল ঢাকায় কাজ করলেও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার পছন্দে ওই বই ছাপানো হয় খুলনা থেকে।
খুলনার হাসান আহমদ রোডের ‘ইউনাইটেড প্রিন্টার্স’ থেকে সব নির্দেশিকা ছাপিয়ে ঢাকায় আনা হতো। ওই প্রেসের মালিক সুকুমার রায় ডিজির আত্মীয় বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সুকুমার রায়কে গতকাল রাতে মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি বিধান কুমারের আত্মীয় নন বলে জানান। তবে নির্দেশিকা বইয়ের কাজ টানা তিন বছর ধরে করছেন বলে স্বীকার করেন। তিনি জানান, তার প্রেস ঢাকার মতো অত্যাধুনিক না হলেও ডিজির ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কাজটা তিনি নিয়মিত পাচ্ছেন।
একটি নির্দেশিকা ছাপাতে রাজস্ব বাজেট থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ একই নির্দেশিকা প্রকল্প থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকায় ছাপানো হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫টি ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা ছাপানোর ভাউচার দেখানো হলেও বাস্তবে মুদ্রণ হয় ১২টি। নির্দেশিকা সেলের কর্মকর্তারা ১৫টি নির্দেশিকা দেখাতে পারেননি। গত চার বছরে ৫০টি নির্দেশিকা ছাপানো হয়েছে। প্রতিটিতে ৪০ হাজার টাকা করে চার বছরে আনুমানিক ৮০ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউটের পাবলিকেশন অ্যান্ড লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো প্রকাশনা ছাপানোর দায়িত্ব আমার হলেও বিধান স্যার নিজেই করতেন। আমাকে কিছুই তিনি জানতে দিতেন না। কারণ, এখানে কোটি কোটি টাকার কাজ হয়।’ তিনি বলেন, ‘এক সময় কমিটি গঠন করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্দেশিকা ছাপা হতো। পরে ডিজি তার পছন্দের লোককে কাজ দিতে গোপনে দরপত্র দিতেন। কারও কিছুই জানার সুযোগ ছিল না।’

নিয়োগ-বাণিজ্য :১২ বছর ধরে কর্মরত অনিয়মিত শ্রমিকদের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ না দিয়ে বাইরের লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরে প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য অফিসে আউটসোর্সিংয়ে ৬৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ডিজি দেড় থেকে দুই লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা।

ডিজির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনো প্রকল্পের পরিচালক থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু বিধান কুমার ‘ডেভেলপমেন্ট অব উপজেলা ল্যান্ড সুইটেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ক্রপ জোনিং সিস্টেম অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পের পরিচালক হয়েছিলেন।

খুলনায় বহুতল ভবন ও জমিজমা :খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের উল্টো পাশে ছেলে স্বপ্নীল কুমার ভান্ডার দিগন্তের নামে বহুতল অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করছেন বিধান কুমার। হাসপাতালের নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত একজন বলেন, ‘কয়েক মাস আগে সাত তলা এই হাসপাতাল ভবনের কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিচে ভিত্তি তৈরি হয়েছে। ভবন নির্মাণে কমপক্ষে দুই কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।’

খুলনার মুজগুন্নি আবাসিক এলাকায় রয়েছে বিধান কুমার ভান্ডারের নামে সাত তলা বাড়ি। দৃষ্টিনন্দন ওই ভবনে বেশ কিছু অফিস ও বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বিধান কুমার ডিজি থাকা অবস্থায় এ বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

খুলনার নতুন জেলখানার বিপরীতে ১২ কাঠা জমি এবং মোস্তর মোড়ে ১০ কাঠা জমি কিনেছেন বিধান কুমার। এর মধ্যে একটি জমি তার স্ত্রীর নামে কেনা। এসব জমির আশপাশে কোনো প্রতিবেশীকে পাওয়া যায়নি।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের জয় বাংলা মোড়ে আছে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের খুলনা কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের জমি। বিধান কুমার ভান্ডারের জমির বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাবেক ডিজির অন্য কোথাও জমি আছে কিনা, জানি না। তবে আমার জমির পাশে তার পাঁচ কাঠা জমি আছে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, বিধান কুমার ডুমুরিয়ায় তার শ্বশুরবাড়ির কিছু মানুষের কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে খুলনায় বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় ৬০-৭০টি হিসাব খুলেছেন। এসব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে তিনি তার টাকা লেনদেন করতেন। তবে এ বিষয়ে ওই অ্যাকাউন্টের মালিকরা কথা বলতে রাজি হননি।

বিসিএস কৃষি ক্যাডার (মৃত্তিকা) অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমীর মো. জাহিদ বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে বিধান কুমার দুই বছর সময় পেয়েছেন। তার অনেক কিছু করার সুযোগ থাকলেও তিনি অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে ছিলেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটি অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমরা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করে আসছি। সচিব বরাবর লিখিত আবেদন দিয়েছি, মিটিংয়েও বলেছি। তার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, বিধান কুমার ভান্ডারের সময়কালে কারিগরি কমিটির কোনো সভা হয়নি। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে জরিপ ও গবেষণাকাজে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। পাঁচটি আঞ্চলিক গবেষণাগারে যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য পাঠানো হয়নি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ডিজি বিধান কুমার ভান্ডার সমকালকে বলেন, ‘ইনস্টিটিউটকে দুই বছরে অনন্য উচ্চতায় নিতে কাজ করেছি। যা করেছি, নিয়মের মধ্যে করেছি। সবকিছুরই ডকুমেন্ট আছে। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি।’

নির্দেশিকা ছাপানোতে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্দেশিকা ছাপানো হয়েছে। এখানে যারা সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন, তাদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। খুলনার প্রেস মানসম্মত নির্দেশিকা ছাপতে পেরেছে এবং টাকার অপচয় বন্ধ হয়েছে।’

অতিরিক্ত কোটেশনের মাধ্যমে অফিসের মালপত্র কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়মিত ক্রয়ের বাইরেও বড় বড় অনুষ্ঠান হয়। মৃত্তিকা দিবসে জমকালো অনুষ্ঠান করতে হয়। এসব অনুষ্ঠানের খরচ বেশি লেগেছে।’ এ ছাড়া অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ মুহূর্তে খুলনায় আছি। কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকায় ফিরব। তখন সরাসরি দেখা করে সব ডকুমেন্ট নিয়ে আসব। এ ডকুমেন্ট দেখানো ছাড়া আপাতত আর কথা বলতে চাই না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments