ম্যাচ তখন বাংলাদেশের মুঠোয়। ৪ উইকেট হাতে নিয়ে ৮ ওভারে ১০৮ রান করার কঠিন সমীকরণ ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান বিশপ অনেকটাই বক্তৃতার সুরে বলে চললেন, ‘বাংলাদেশের এই দলটাই ভবিষ্যৎ। প্রতিভার ছড়াছড়ি। বোলিং ইউনিটটি অবিশ্বাস্য। কোচ ফিল সিমন্সকে সময় দিন। ভাবুন, এগোতে চাইলে এটাই ভিত। এখন না হলে আর কখনোই নয়।’
দলটা পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে চতুর্থ। এমন একটা দলকে তাদেরই মাঠে ৩-০ তে ধবলধোলাই করল কিনা পুরো শক্তির দল নিয়ে মাঠে নামতে না পারা র্যাঙ্কিংয়ে নবম বাংলাদেশ! সেটাও কী দোর্দণ্ড প্রতাপে। গতকাল সেন্ট ভিনসেন্টে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে আগে ব্যাট করে ১৮৯ রান করার পর বাংলাদেশ জিতেছে ৮০ রানে। টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের এর চেয়ে বড় জয় আছে মাত্র একটিই।
এই বিশ্ব রেকর্ডই বলে দিচ্ছে, সিরিজে কেমন দুর্দান্ত ছিলেন বোলাররা। যেটির আরও বড় প্রমাণ, সিরিজে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়া পাঁচ বোলারই বাংলাদেশের।
শেষ ম্যাচে উইকেট একটু ব্যাটিং–সহায়ক ছিল। জাকের আলী যেটিকে সবচেয়ে ভালো কাজে লাগিয়েছেন। এর আগে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা পারভেজও (২১ বলে ৩৯)। বিশপ বলছিলেন, এই ছেলে পাওয়ারে বিশ্বাসী। আর জাকের? ধারাভাষ্যকার স্যামুয়েল বদ্রি জাকেরের ব্যাটিংকে সারসংক্ষেপ করেছেন সবচেয়ে ভালো, ‘দ্য ক্যারিবিয়ান ক্রিপ্টোনাইট শো।’
জাকেরের ৪১ বলে অপরাজিত ৭২ আসলেই সুপারম্যানসুলভ ইনিংস। তবে চরিত্রটা যে মানুষেরই তৈরি, আর কে না জানে মানুষের অসম্ভব বলে কিছু নেই। আর্নস ভেলের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭ উইকেটে ১৮৯ ওঠার পর তাসকিন তাঁর প্রথম ওভারে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়ার পর মেহেদী হাসান দ্বিতীয় ওভারেই হেনেছেন আঘাত। ফল? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২ ওভারে ২ উইকেটে ৭। চেপে ধরার এই ভিতটা পেয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় ও চতুর্থ ওভারে মোট ২১ রান তুলে ফাঁস আলগা করার চেষ্টা করেছিলেন পুরান-চার্লস। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারে আবারও মেহেদীতে আউট পুরান, এবার বোল্ড। পরের ওভারে তিন বলের মধ্যে আউট রোস্টন চেজ ও চার্লস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ৪৭। ম্যাচের ভাগ্যটা যেন তখন নির্ধারিত হয়ে গেছে।
দারুণ অধিনায়কত্ব করা লিটনের ব্যাটে খরা কাটেনি। তবে ১৩ বলে ১৪ রানের ইনিংসটির ভূমিকা আছে পারভেজের সঙ্গে তাঁর ৪.৪ ওভারের জুটিতে ৪৪ রান উঠে যাওয়ায়। পারভেজের মারা দুটি ছক্কাতেই বিশপের কণ্ঠে ঝরেছে মুগ্ধতা। এমনকি ১৩ বলের ব্যবধানে মিরাজ, শামীম ও মেহেদী আউট হওয়ার পরও বাংলাদেশের ইতিবাচক মানসিকতার ব্যাটিংয়ের ধারা বদলায়নি।
সুপারম্যানসুলভ ব্যাটিংয়ে সেটারই পূর্ণরূপ দিয়েছেন জাকের। সেখানেও কি নাটক কম হয়েছে! ১৪.৩ ওভারে রানআউট হয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে জাকের ফিরে গিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ার ভিডিও রিপ্লেতে দেখলেন জাকের নয়, অন্য প্রান্তে শামীম আউট। ড্রেসিংরুম থেকে জাকের ক্রিজে ফেরার এক বল পর মেহেদীও আউট! পরের গল্পটা অনেকটাই সুপারম্যান যেমন একাই পৃথিবীকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন, তেমনি জাকেরও নিজ কাঁধে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন প্রথম ইনিংসেই জয়ের সুবাস পাওয়ার বন্দরে।
প্রথম বাউন্ডারির আগে তাঁর রান ছিল ১৩ বলে ১০। এরপর ধীরে ধীরে মেলে ধরলেন নিজেকে। শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশের তোলা ৭৫ রানের মধ্যে ২৩ বলে ৫৪ জাকেরের। ক্যারিবিয়ান ধারাভাষ্যকারেরা বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘আ সুপারস্টার ইন মেকিং!’
টেস্ট সিরিজের সেই ৯১ দিয়ে জাকের এই দেশের সমর্থকদের মনের মণিকোঠায় আসন করে নিয়েছেন আগেই। কাল যেটা করলেন, সেটাকে স্রেফ নতুন দিনের দর্শন দেওয়া বলা যায়। ছক্কা মেরে বল স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়েছেন দুবার। শেষ ওভারে তিন ছক্কায় একাই তুলেছেন ২৫!
জাকেরের এই ৪১ বলে ৭২ আসলে ‘হোয়েন আ ম্যান বিকামস সুপারম্যান।’ আর বোলারদের অবিশ্বাস্য বোলিং আসলে ক্যারিবিয়ান সুপারম্যানসুলভ ব্যাটসম্যানদের বুদ্ধিমান মানুষের কাছে হেরে যাওয়ার এক হিরণ্ময় উদাহরণ। আর সেই উদাহরণ তৈরি করেই টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো তিন ম্যাচের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ।
বলতে পারেন, এ এক নতুন বাংলাদেশ! বলতে পারেন, তলা থেকে উঠে এসে ফণা তুলে ছোবল মারার এ এক অনন্য তৃপ্তি। অধিনায়ক লিটন সেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই ম্যাচ শেষে বললেন, ‘ওদের পাওয়ার হিটার ছিল, কিন্তু আমরা ১৯০ (১৮৯) ডিফেন্ড করেছি। এটা বড় অর্জন। এখন আমরা সত্যিই ভালো খেলছি। আবার যখন খেলব, তখনো ভালো খেলা দরকার।’
লিটনের এই পরেরবারও ভালো খেলার মানসিকতার পেছনের গল্পটা আপনি খুঁজে নিতে পারেন, ম্যাচসেরা জাকেরের কথায়, ‘সংস্করণ যেটাই হোক, আমি জানতাম ক্যারিবিয়ানরা খুব কঠিনভাবে চড়াও হবে। এখানে বিশ্বকাপে খেলেছি, কিন্তু ভালো খেলিনি। তাই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম এই সিরিজ নিয়ে।’