দেশের ছয় ব্যাংকে নিরীক্ষায় নিয়োগ দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক

0
222
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া ছয় ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনায় দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং ও কেপিএমজি। এ জন্য ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এই নিরীক্ষায় অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

 

যে ছয় ব্যাংকে নিরীক্ষা শুরু হবে সেগুলো হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। সূত্রমতে, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নিরীক্ষা করবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সম্পদের মান। কেপিএমজি নিরীক্ষা করবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের সম্পদের মান। এর মধ্যে চারটি ব্যাংকের মালিকানা ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের হাতে। দেশে গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এডিবির একাধিক প্রতিনিধি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁরাই এই ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পর্যালোচনার পরামর্শ দেন। ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে এ নিয়ে তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিরীক্ষা দলকে সর্বোচ্চ সহায়তা করতে বলা হয়েছে ছয় ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল রোববার এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাংক ছয়টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সভা করেন। সভায় এডিবির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। সভায় নিরীক্ষকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আমরা চাই ব্যাংকের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার প্রকৃত হিসাব বের হোক। এ ছাড়া কারা সুবিধাভোগী তা-ও জানা প্রয়োজন। এতে ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এই নিরীক্ষা করবে, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না—মোহাম্মদ নূরুল আমিন, চেয়ারম্যান, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।

একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসবেন। পরের সপ্তাহ থেকে বিদেশি নিরীক্ষকেরা আসবেন। তাঁদের সহায়তা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রাথমিক পরিদর্শনে এসব ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নামে-বেনামে বের করে নেওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। এখন আন্তর্জাতিক দুই প্রতিষ্ঠান ঋণের গতিপথ, কারা দোষী ও সুবিধাভোগী তা বের করবে। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের সম্পদের মান নির্ধারণ করে দেবে।

কোন ব্যাংকের ক্ষত কেমন

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। ব্যাংকটির ৫৬ শতাংশ বা ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক প্রবাসীদের হলেও ব্যাংকটি শুরু থেকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির জন্য আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার এই ব্যাংকের এমডি থাকাকালে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ এস আলম গ্রুপ তুলে নেয়। গ্রুপটির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিনের অনেক হিসাব থেকে টাকা তোলার তথ্যও মিলেছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকও শুরু থেকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ১৮ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ একাই নিয়েছে, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার বিপরীতে কোনো জামানতও নেই।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের কাছে যায়। ব্যাংকটি থেকে এস আলম গ্রুপ নামে ও বেনামে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।

এক্সিম ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে। তিনি আওয়ামী লীগের ১৫ বছর মেয়াদের পুরো সময়ে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন। এর প্রভাবে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি ছিল ওরিয়ন গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে বিদেশিরা মালিকানা নিলেও ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

ছুটিতে ছয় এমডি

গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়ার পর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে গত শনিবার তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এরপর গতকাল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি মোহাম্মদ ফোরকানউল্লাহ ও ডিএমডি আবদুল হান্নান খানকে ছুটিতে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি হাবিব হাসনাত, এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তবে ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি আগেই পদত্যাগ করায় সেখানে কাউকে ছুটিতে পাঠানো হয়নি।

গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ বিধান জারি করে। এ বিধানের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষমতা পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, আমরা চাই ব্যাংকের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার প্রকৃত হিসাব বের হোক। এ ছাড়া কারা সুবিধাভোগী, তা–ও জানা প্রয়োজন। এতে ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এই নিরীক্ষা করবে, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here