সম্প্রতি সরকার শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়েছে। এর মধ্যে ওষুধ, রেস্তোরাঁ, মুঠোফোন সেবা, ইন্টারনেটের মতো খাতে বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করলেও ফলমূল, বিস্কুট, টুথপেস্ট, সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যে বাড়তি ভ্যাটের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন আগে থেকেই নানা কারণে চাপের মুখে তখন হঠাৎ করেই অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট বাড়ানোর নজিরবিহীন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটা ব্যবসায়ী তো বটেই দ্রব্যমূল্য নিয়ে চাপে থাকা সাধারণ মানুষের ওপরও চাপ বাড়াবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্যাট বাড়িয়ে টাকা সংগ্রহের জন্য সরকার কেন মরিয়া হয়ে উঠল? এছাড়া এর ফলে ব্যবসার ওপরও চাপ বাড়লে সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না এমন আলোচনাও হচ্ছে। বাংলাদেশে ভ্যাট এমন এক সময়ে বাড়ানো হয়েছে যখন দেশটিতে টানা তিনমাস ধরে উচ্চ মূদ্রাস্ফীতি চলছে। পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতিও প্রায় ১৩ শতাংশ।
আরও পড়ুনঃ সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেইঃ ফখরুল
সরকার যে ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে রাজস্ব আয় বাড়বে কমবেশি ১২ হাজার কোটি টাকা।
রাষ্ট্রপরিচালনা জন্য এই টাকা দরকার সরকারের। কিন্তু সরকার একদিকে ভ্যাট বাড়িয়ে টাকা আদায় করছে। অন্যদিকে নতুন নতুন ব্যয়ের খাত তৈরি করছে। অর্থাৎ টাকার সংকটে ব্যয় কমিয়ে টাকা বাঁচানোর পরিবর্তে সরকার উল্টো টাকা খরচ করছে।
সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে সাত হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে খবর দিচ্ছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। আবার বিদেশে ৮২টি বাংলাদেশি মিশনে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বৈদেশিক ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী যেটা দিতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। এরসঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে পুলিশ, র্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন। যেখানেও নতুন করে খরচ হবে সরকারের।
যখন টাকার সংকট তখন করের বোঝা বাড়িয়ে সরকারের এমন খরচের সমালোচনা হচ্ছে। জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বেতন বাড়ানোর মতো বাড়তি খরচ এই মুহূর্তে দরকার ছিলো না। আমাদের কাছে ঠিক বোধগম্য না যে এই মুহূর্তে এতো উচ্চ পরিমাণে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কী প্রয়োজন আছে! সরকার আরও কিছু জায়গায় (খরচ করার) নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো তারা পিছিয়ে দিতে পারে।’
কিন্তু সরকার করেছে উল্টোটা। আর তাতে করের চাপ বেড়েছে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের ওপর। সরকার হন্যে হয়ে টাকা খুঁজছে, কারণ তার টাকার ঘাটতি আছে। কিন্তু সরকারের টাকার ঘাটতি কেন হলো? এখানে দুটি কারণ আছে।
প্রথমটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরকারি কোষাগারে টাকার যে ঘাটতি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনা পরবর্তী দুই মাসে যে অস্থির পরিস্থিতি তাতে করে সরকারের রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর -এই পাঁচ মাসে সরকার যে রাজস্ব আয় করেছে, সেটা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কম। এই পাঁচ মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষমাত্রা ছিলো তার তুলনায় আদায় কম হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বছরের বাকি সময়ে টাকার এই ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। তাই সহজ সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়ানোর পথে গেছে সরকার।
তবে এর বাইরেও আরেকটি কারণের কথা বলছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সেটা হচ্ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ। তিনি বলেন, ‘দেখবেন, যে ভারতীয় কোম্পানি আদানি সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে তাদের ৮৩০ মিলিয়ন ডলারের পাওনা বাকি রয়েছে। কিন্তু এরকম পাওনাদি শুধু ওই বিদ্যুৎ কম্পানি না, যারা আমাদের এখানে গ্যাস এক্সপ্লোরেশন করে তারা এবং বিদেশি টেলিকম কোম্পানি রয়েছে তাদেরও বিদেশে টাকা প্রেরণ করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তো এগুলো হিসাব করা হলে দেখা যাবে কয়েক বিলিয়ন ডলার বকেয়া পাওনা রয়ে গেছে যেগুলোর জন্য ডলার দরকার। সুতরাং সে হিসেবে সরকারের আসলে খুব দ্রুতই অর্থের প্রয়োজন।’
সরকার কী বলছে?
একদিকে মহার্ঘ ভাতা বা বৈদেশিক ভাতার মতো খরচ বাড়ানো, অন্যদিকে ভ্যাট আরোপ করা নিয়ে যে সমালোচনা সরকার অবশ্য তাতে গুরুত্ব দিতে চায় না।
বুধবার অর্থ উপদেষ্টা অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে ভ্যাটের সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, এখানে কোনো সম্পর্ক নেই। মহার্ঘ ভাতা যদি আমরা দেই সেটা আলাদা হিসাব করব।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্যই ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ হলো লোয়েস্ট ট্যাক্স পেয়িং দেশ। এতো কম ট্যাক্স দিয়ে আপনি কীভাবে চান যে এটা দিয়ে সবকিছু দেখভাল হবে? অনেকেই প্রশ্ন করে যে, রাজস্ব কেন বাড়ান না? বলেন কোথায় বাড়াব? আমরা আসলে (বাড়ানোর) ক্ষেত্রগুলো খুঁজছি। যেন এটা যৌক্তিক হয়, আমরা চেষ্টা করব। অর্থনীতির জন্যই রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
আমাদের ভিডিও সংবাদ গুলো দেখতে যুক্ত থাকুন ইউটিউব দৈনিক সচেতন বার্তা চ্যানেলে।