Wednesday, September 24, 2025
Homeআন্তর্জাতিকবাংলাদেশদেশে ভারতীয় নাগরিক কলেজ অধ্যক্ষ পদে!

দেশে ভারতীয় নাগরিক কলেজ অধ্যক্ষ পদে!

রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মোবাশ্বের হোসেন একজন ভারতীয় নাগরিক। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনাও করেছেন সেখানেই। সব সার্টিফিকেটই ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। কিন্তু এসব তথ্য গোপন করে তিনি  চাকরি নেন। সেই কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন দীর্ঘদিন। গেল এপ্রিল মাসে তাকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছে কলেজ কমিটি।

অধ্যক্ষ হওয়ার পর তাকে নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। অভিযোগ ওঠে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। বিষয়টি নিয়ে তাকে ছয় মাসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও তিনি অধ্যক্ষ পদে বহাল তবিয়তে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, মোবাশ্বেরের খুঁটির জোর কোথায়?

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ মার্চ কলেজের পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির সভায় তার স্কুল থেকে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত ভারতীয় একাডেমিক সনদ এবং লেখাপড়ার সময় নাগরিকত্বের পরিচয়ের বিষয়ে জোরালোভাবে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। পরবর্তী সভায় তাকে কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলে ওই কমিটি। পরে ২৫ মার্চের সভায় তার যাবতীয় ব্যাখ্যা ও প্রশ্নোত্তর পর্যালোচনা শেষে ১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে সভায় উপস্থিত কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য এই সিদ্ধান্তে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবরে তার মোবাশ্বেরের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে অভিযোগ দেন কলেজটির সদ্যবিলুপ্ত পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধির সদস্যরা।

গত ১ এপ্রিল থেকে মোবাশ্বের কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২৫ এপ্রিল কলেজ পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির সভায় তাকে একটি অঙ্গীকারপত্র দাখিল করতে বলা হয়। তাতে আগামী ছয় মাসের জন্য কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সাথে তার সকল সার্টিফিকেট ভারতীয় ও তিনি দেশটির নাগরিক হওয়ায় অ্যাডহক কমিটির নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি সদস্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। কিন্তু কলেজ পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির তৎকালীন সভাপতি নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত বিদ্যোৎসাহী সদস্য সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা মিহির কান্তি ঘোষালকে ম্যানেজ করেন তিনি। অ্যাডহক কমিটির সভার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা/গোপন করে তার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নিয়োগপত্রে আমূল পরিবর্তন আনেন। এছাড়া একই স্মারক নম্বর ও তারিখে তার সুবিধামতো নতুনভাবে আরেকটি নিয়োগপত্র তৈরি করে তাতে সভাপতির স্বাক্ষর নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করেন।

অভিযোগে বলা হয়, কারচুপি ও জালিয়াতি করে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেয়ে যান। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠভাজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও মিহির কান্তি ঘোষালের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এরকম একটি অনৈতিক সিদ্ধান্ত জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কমিটি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। ৩০ এপ্রিল বিষয়টি নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃপক্ষকে জানালে সেই নিয়োগপত্রটি বাতিল করতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু এ বিষয়টি কলেজ পরিচালনা অ্যাডহক কমিটির কাছে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রাখা হয়।

এছাড়া দ্বিতীয়বার তিনি আরেকটি নিয়োগপত্র তৈরি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলেও সেটি অবৈধ আপত্তি তুলে অভিযোগ দাখিল করেন কলেজ শিক্ষকরা। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আবারও সেটি বাতিল করে পত্র জারি করে।

অভিযোগ উঠেছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ মাসে প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিভিন্ন কার্যক্রমে মোবাশ্বের হোসেনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কূটকৌশলের কারণে কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তার বিভিন্ন স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এখনো মোবাশ্বের নিজেকে রক্ষায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি দায়ে অভিযুক্ত ও জড়িত ব্যক্তি ছাড়াও তাদের দোসরদের সাথে তিনি গোপন নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলেছেন। যা প্রতিষ্ঠানের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ বলেও মনে করে অ্যাডহক কমিটি।

এছাড়া গত ২৯ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা মতে চলমান কলেজ পরিচালনা অ্যাডহক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবাশ্বের হোসেন তার দায়িত্বের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মোবাশ্বের একজন ভারতীয় নাগরিক। যদিও তিনি নিজেকে বাংলাদেশি দাবি করেন। টাঙ্গাইলের একটি ঠিকানা দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আইডিয়াল কলেজ ও অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তবে বিষয়টি একটা পর্যায়ে চাউর হয়ে যায় যে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। তিনি যে ভারতীয় নাগরিক ও ভারতের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সেই সব সার্টিফিকেট ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি প্রাথমিক স্কুল থেকে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে লেখাপড়া করেছেন। এছাড়া তথ্য গোপন করে তিনি এমপিওভুক্ত হন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৬ সালে পাসপোর্ট করার সময় মোবাশ্বের হোসেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার সদর ইউনিয়নের দেলদুয়ার গ্রামের ঠিকানা দেন। যাতে তিনি দাবি করেন, সেই গ্রামে ১৯৯০ সালের পর থেকে বসবাস করে আসছেন। তার বাবা সেখানে ‘ভারতীয় মওলানা’ নামে পরিচিত। ২০০১ সালে ওই ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আবু সাঈদ মিয়া স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্র অনুসারে তিনি ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সেই চেয়ারম্যান জীবিত না থাকায় সনদটি যাচাই করা যায়নি। ২০০৬ সালেই ঢাকার আগারগাঁও থেকে ইস্যু করা পাসপোর্টে পূর্ববর্তী কোনো পাসপোর্টের তথ্য বা রেকর্ড ছিল না। পরে তিনি বেশ কয়েকবার পাসপোর্ট নবায়ন করেছেন, এমআরপি ও ই-পাসপোর্টও গ্রহণ করেছেন।

ঢাকা মেইলের হাতে আসা ডকুমেন্টসে দেখা যাচ্ছে, তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ১৯৮১ সালে পশ্চিমবঙ্গের পুবার পান্ডুক দিননাথপুর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিষয়ে বিএসসি এবং ১৯৮৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাস করেন।

ভারতে জন্ম নেওয়া মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশে এসে প্রথমে আশ্রয় নেন পুরান ঢাকায়। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয়ে ঢাকার বংশাল এলাকায় মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি নেন। পরে ১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন জগন্নাথ সরকারি কলেজে নৈশকালীন কোর্সে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হয়ে রসায়ন বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর এমএসসি নৈশকালীন কোর্সে ভর্তি হলেও তিনি ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিএসসির সনদ জমা দেননি। তার বিএসসি ও বিএড ডিগ্রির সাময়িক সনদ ১৯৯৫ সালে ইস্যু করা হয়। কিন্তু ১৯৯৪ সালে তিনি মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে সরকারি এমপিওভুক্ত হয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত হন। এমপিওভুক্তির আবেদনপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে শুধু পরীক্ষার নাম, পাসের সাল আর ফলাফল উল্লেখ করলেও কৌশলে ভারতীয় সনদের বিষয়টি গোপন করা হয়। এরপর আইডিয়াল কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেওয়ার সময়ও তার দেওয়া বায়োডাটাতে শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে শুধু পরীক্ষার নাম আর ফল উল্লেখ করেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেননি।

এসব অভিযোগ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবাশ্বের হোসেনের সাথে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি। সূত্রঃ ঢাকা মেইল।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com