আমাদের দেশে চলমান নিত্যপণ্যের চড়া দামের মধ্যেই বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দর। ফলে দুঃসময়ে জনগণের জীবনযাত্রায় যোগ হলো আরো একটি চাপ। জনগণের কাছে এ বিষয়টি যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা এই প্রথম নয়। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে কয়েকবার। বিগত জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলেও থেমে ছিল না জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। তখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছিল আটবার। আন্তর্জাতিক বাজারে তখন দাম কম থাকলেও তারা না কমিয়ে দাম বাড়িয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি ও একটি গোষ্ঠী লাভবান হলেও এর নেতিবাচক ফল শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণের ওপর বহুমাত্রিক বোঝা তৈরি করে। আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে (ইকোসিস্টেমের ন্যায়) বাড়তে থাকে পণ্য পরিবহন ও জনপরিবহন ব্যয়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় এবং স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনে এখন গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এবং যাত্রী ভোগান্তি থেকে বিরত থাকার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। ফলে জনগণকে বাধ্য হয়েই গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।
লোকসান কমানো এবং ভারতে পাচার রোধ করতে সম্প্রতি দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তবে বাংলাদেশে যখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তখন ভারতে পেট্রল ও ডিজেলের দাম কমানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উৎপাদন শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তের ঘোষণার পরই দেশটিতে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ১১ রুপি এবং পেট্রলের দাম পাঁচ রুপি কমায়।
আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে বিপিসি লোকসানের মুখে পড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল ৬৫ টাকায় বিক্রি করতে গিয়ে লিটারে ১৩ থেকে ১৪ টাকা লোকসান হচ্ছে এবং প্রতিদিন ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিপণনে ২০ কোটি থেকে ২২ কোটি টাকার মতো লোকসান হচ্ছে। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে দাম কম থাকায় বিপরীতে দেশে ততটা না কমিয়ে সর্বশেষ সাত বছরে বিপিসি প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তবে যা-ই হোক না কেন, পাঁচ মাস লোকসান দিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, বিশ্ববাজারে যেহেতু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছেই, এখন তো দেশে দাম বাড়াতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববাজারে দর যখন কম ছিল, তখন জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। তাহলে এখন বাড়ানো হলো কেন? মূল সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের দেশে যখন তেলের দাম বাড়ে, ঠিক যে অনুপাতে বাড়ানো উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি অনুপাতে বাড়ানো হয়। দেশের স্বার্থে এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই সরকারের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ার কারণে গণপরিবহনে ১০০ টাকার ভাড়া সর্বোচ্চ ১১০-১১৫ টাকা হতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তেলের খরচ দেখিয়ে ১০-১৫ টাকার জায়গায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা এবং দেশের জনগণকেও যেন তা ‘ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ’ হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, হঠাৎ করেই একসঙ্গে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘটনা এটাই প্রথম। পাশাপাশি বিভিন্ন সেতুর টোলও বাড়ানো হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বাস ও ট্রাকের প্রতি ট্রিপেই খরচ বেড়ে গেছে। আর এর মাসুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রী তথা জনগণ ও ব্যবসায়ীদের। মনে রাখতে হবে, একটি দেশের জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে রেখে ওই দেশের সার্বিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ভালোভাবে করা সম্ভব নয়। জনস্বার্থ বিবেচনা করেই যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য এবং ফিলিপাইনের লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপাইন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর