ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে৷ আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি এখন অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আবার স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন। আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন ওই ইনস্টিটিউটেই আবার স্নাতকোত্তর (অন্য বিষয়ে সান্ধ্য কোর্স) করছেন তিনি। নাহিয়ান ও লেখক দুজনেরই বয়স প্রায় ৩২ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র বলতে আসলে যা বোঝায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এখন আর তা নন। স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন শেষ করে রাজনীতির সঙ্গে ‘নেতৃত্ব’ ধরে রাখতে তাঁরা সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
অন্যদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ—দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র। রওনকুল ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলা বিভাগ থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি এখন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ (সান্ধ্য কোর্স) থেকে আবার স্নাতকোত্তর করছেন।
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত ছাত্র, তাঁরাও অনিয়মিত ছাত্র। তাঁদের হয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে অথবা আমাদের অছাত্র বলে তাঁরা নিজেদের সামাজিকভাবে সমাদৃত করতে চান। আমাদের অছাত্র বললে একই বিবেচনায় তাঁরাও যে অছাত্র হয়ে যান, সেই বিচার-বিশ্লেষণ তাঁরা করতে পারছেন না
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ
সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ ভর্তি হয়েছিলেন ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে। বাংলা বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে এখন সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থাকে স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন তিনি। রওনকুলের বয়স প্রায় ৩৮ আর সাইফের বয়স প্রায় ৩৫ বছর। বয়সই বলে দিচ্ছে তাঁরা নিয়মিত ছাত্র নন।
ছাত্রদলের নেতাদের ‘অছাত্র’ ও ‘চাচ্চু’ বলে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা। অন্যদিকে ছাত্রদল বলছে, ছাত্রলীগের নেতাদের ‘ছাত্রত্ব নেই’। তাঁরা ‘সন্ত্রাসে’ জড়িত। এ নিয়ে দুই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ চলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে৷
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ বলেছেন, ছাত্রলীগের নেতারা যে প্রক্রিয়ায় ছাত্র, তাঁরাও সেই প্রক্রিয়ায় ছাত্র। তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত ছাত্র, তাঁরাও অনিয়মিত ছাত্র। তাঁদের হয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে অথবা আমাদের অছাত্র বলে তাঁরা নিজেদের সামাজিকভাবে সমাদৃত করতে চান। আমাদের অছাত্র বললে একই বিবেচনায় তাঁরাও যে অছাত্র হয়ে যান, সেই বিচার-বিশ্লেষণ তাঁরা করতে পারছেন না।’
অছাত্র ও ছাত্রত্ব নেই—এই বিতর্কের শুরু মূলত ২৪ মে থেকে। সেদিন ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের মিছিলে বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পিটিয়ে ছাত্রদলের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মীকে রক্তাক্ত করা হয়। এরপর ২৬ মে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে হাইকোর্ট মোড়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। সেখানে গিয়েও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পেটায় ছাত্রলীগ। পরপর দুই দফা হামলার বিষয়ে ছাত্রলীগ বলছে, অছাত্রদের নিয়ে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে ছাত্রদল। ‘প্রগতিশীল’ ও ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীরা যে কারণে ছাত্রদলকে প্রতিহত করেছে বলে দাবি ছাত্রলীগের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারাও নিয়মিত ছাত্র নন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগে ভর্তি হন আবার স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্টে) করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন আইন বিভাগে ভর্তি হন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। নিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে এখন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার ওপর কোর্স করছেন তিনি। সনজিতের বয়স ৩০ পেরিয়েছে, সাদ্দামের বয়সও ৩০ ছুঁই ছুঁই৷
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আকতার হোসেন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন। ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমান সংগীত বিভাগে ভর্তি হন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে৷ স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে এখন জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগে সান্ধ্য স্নাতকোত্তর করছেন তিনি৷
আকতার থাকতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে। নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পর তিনি হল ছাড়েন। আর আমান ২০১০ সালে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে উঠলেও ছাত্রদল–সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২২ দিনের মাথায় তাঁকে মারধর করে হলছাড়া করে ছাত্রলীগ। আকতারের বয়স প্রায় ৩৩ বছর আর আমানের বয়স প্রায় ৩১ বছর৷
নিয়ম অনুযায়ী, শুধু নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় থাকার অধিকার রাখেন। সান্ধ্য কোর্স বা অনিয়মিত কোর্সের কোনো শিক্ষার্থীর হলে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু অনিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থী হয়েও হলে থাকছেন ছাত্রলীগ নেতা সনজিত ও সাদ্দাম। সনজিত থাকেন জগন্নাথ হলে আর সাদ্দাম থাকেন স্যার এ এফ রহমান হলে।
এ বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, তিনি ও সনজিত চন্দ্র দাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনেই তাঁরা হলে থাকছেন।