Sunday, September 14, 2025
Homeঘটনা-দুর্ঘটনাগুলশান কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই

গুলশান কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই

পুড়ে গেছে দোকানের মালামাল। অবশিষ্ট বলতে কিছুই নেই। নিঃস্ব এক ব্যবসায়ীর হৃদয়বিদারক কান্না ।

রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের আশপাশে এখনো পোড়া গন্ধ। বিভীষিকাময় সেই দৃশ্য ভুলতে পারেননি ওই ভবনসহ আশপাশের ভবনে থাকা কেউ। কামাল আতাতুর্ক সড়কের অগ্নিকাণ্ডের দুই দিন পরই ঘটল আরেকটি ঘটনা। এবার আগুনে পুড়ল গুলশান ১ নম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কাঁচা ও সুপার মার্কেট। এখানকার দুই শতাধিক দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছেন গরিব দোকানদাররা। এই মার্কেটের ক্রেতা গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা। দোকানমালিকরা বলছেন, আগুনে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাদের উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে এ আগুন লাগানো হয়েছে বলে তারা সন্দেহ করছেন। গতকাল ভোর পৌনে ৬টার দিকে এই মার্কেটের কাঁচাবাজার অংশে আগুন লাগে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ডিডি) দেবাশীষ বর্ধন।

তিনি বলেন, ডিএনসিসি মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটসহ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী এবং আশপাশের সাধারণ মানুষ কাজ করেছে। একটি বেবিশপের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরে সবার সহযোগিতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। আগুনের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটির প্রধান করা হয়েছে সংস্থাটির উপপরিচালক (প্রশাসন) শামীম আহসান চৌধুরীকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিনকে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাদের আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি জানিয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাঁচাবাজারের ওই মার্কেটটিতে ৩৬০টি দোকান ছিল। আট মাস আগেও মার্কেটটিতে আগুন লাগে। দ্বিতীয় দফায় এই আগুন লাগায় তারা সর্বস্ব হারিয়েছেন। ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি একই মার্কেটে আগুন লাগে। এর ১৬ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ডে  মার্কেটের প্রায় ৬০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গতকালের আগুনে কাঁচাবাজারের সামনের পাঁচতলা গুলশান শপিং সেন্টারের কয়েকটি দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কাঁচাবাজার লাগোয়া গুলশান ১ নম্বর ডিএনসিসি পাকা মার্কেট তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ভোর পৌনে ৬টার দিকে কাঁচাবাজারটিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে তা নেভাতে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেন আগুন নেভানোর কাজে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময়ের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও কাঁচাবাজার অংশ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দোকানে ঢুকে ঢুকে তল্লাশি শুরু করেন। এ সময় বেরিয়ে আসছিল পোড়া মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের ক্যান। গুলশান ১ নম্বর ডিএনসিসি মার্কেটের দোতলা ভবনের পূর্বপাশ ঘেঁষে লোহার কাঠামোয় টিন দিয়ে বানানো কাঁচাবাজারে মাংস ও মাছের দোকান। পাশাপাশি মুদি ও সুগন্ধির দোকানও ছিল। যদি কিছু মালামাল অক্ষত থাকে এই ভেবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর নিজ নিজ দোকানে গিয়ে তল্লাশি শুরু করেন দোকানদাররা। এরপর তারা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অক্ষত থাকা কিছু মালামাল বের করে আনে। আমদানি করা খাদ্যপণ্য ও প্রসাধনীর অনেক দোকানের পাশাপাশি প্লাস্টিকের খেলনার দোকানও ছিল সেখানে। তবে এসব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মার্জিয়া পারফিউম শপ, ব্রাদার্স জেনারেল স্টোর, ফেনী জেনারেল স্টোরের মালিকরা জানান, ২০১৭ সালে সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল স্বপ্নপোড়া আগুন। এরপর নতুন করে বাঁচার তাগিদে আবারও নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। সব হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাতদিন কঠোর পরিশ্রমও করেছেন। প্রত্যাশামাফিক বিকিকিনি হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল তাদের মনে। কিন্তু গতকাল ভোরের আলো ফোটার আগেই ফের ভয়াবহ আগুনে দুমড়ে-মুচড়ে যায় তাদের স্বপ্ন। আগুন লাগার খবরে সবাই দৌড়ে দোকানে এসে দেখেন, কিছুই অবশিষ্ট নেই, চোখের সামনে স্বপ্ন পুড়ে ছারখার। ভিতরে তখনো জ্বলছে আগুন। কেবল হাহাকার ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর সবাই উদ্্ভ্রান্তের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন নিজ নিজ দোকানে। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তারা অক্ষত মালামাল খুঁজে ফিরছিলেন। প্রত্যেকের দোকানে লাখ লাখ টাকার মালামাল ছিল। মার্কেটের পূর্বপাশের একটি দোকানে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে তিনটি ফ্রিজ। কিন্তু ফ্রিজের ভিতরে মাছগুলো অক্ষত। পোড়া দোকানের শেষ সম্বল হিসেবে সেই মাছ সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ইমরুল নামে এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখানে সামুদ্রিক মাছ বেশি বিক্রি হয়। সবগুলো ফ্রিজেই এ ধরনের মাছ সংরক্ষিত ছিল। ফ্রিজ পুড়ে গেলেও মাছগুলো কিছুটা ভালো আছে। তাই সরিয়ে নিচ্ছি।’ মার্কেটের বাইরেও এক মাছ ব্যবসায়ীকে পিকআপ ভ্যানে অর্ধপোড়া মাছ সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। মাছ দোকানের পাশে উপহার ক্রোকারিজ নামের একটি দোকানে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া হাঁড়ি-পাতিল, চামচ ও বিভিন্ন পণ্য জমা করছেন কর্মচারীরা। ডায়েট নামে একটি মুদিদোকানে দেখা যায় কর্মচারীরা পুড়ে যাওয়া পণ্যের মধ্যে থেকে আধপোড়া তেলের বোতল, আটা, চালের বস্তা উদ্ধার করে জড়ো করছেন। এ ছাড়া মার্কেটের মাঝামাঝি ও আশপাশে দেখা যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আলু, পিয়াজ, চাল, ডাল, আপেল, কমলাসহ বিভিন্ন সবজি, মশলা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। নিম্ন আয়ের লোকজন সেগুলো থেকে কিছু অবশিষ্টাংশ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। ওই মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী মতিউর রহমান জানান, ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি মার্কেটে আসেন। এ সময় অপর নিরাপত্তাকর্মী তাকে জানান, মার্কেটের আওয়ালের পানের দোকান থেকে বিকট আওয়াজ হয়েছে। দ্রুত তারা বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেন। ভোর পৌনে ৬টার দিকে দেখেন, ওই দোকান থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তারা বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনাস্থলে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন দোকানি জানিয়েছেন, রাতে দোকানগুলোতে কেউ থাকে না, বাজারের কলাপসিবল গেটে তালা মেরে নিরাপত্তাকর্মীরা বাইরেই থাকেন। কাঁচাবাজারের সামনে পাঁচতলা গুলশান শপিং সেন্টারেও আগুন ছড়িয়েছিল। সেখানে দোতলার বেশ কয়েকটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বিপণিবিতানে রয়েছে হার্ডওয়্যারের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান। অগ্নিকান্ডে  ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছ থেকে সহায়তা চেয়ে বলেন, দুই বছর আগে অগ্নিকান্ডে র পর তেমন সহায়তা তারা পাননি। নিজেদের চেষ্টায়ই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। অগ্নিকান্ডে র খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মামলা জটিলতার কারণে এখানে স্থায়ী একটি মার্কেট গড়া যাচ্ছে না। তিনি মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেবেন।

ব্যবসায়ীরা ১০ হাজার টাকা ও শ্রমিকরা ২০ কেজি চাল : গুলশান ১ নম্বর ডিএনসিসি কাঁচা ও সুপার মার্কেটে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা ও শ্রমিকদের ২০ কেজি চাল দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। গতকাল বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। তিনি বলেন, এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মানবিক দিক বিবেচনা করে নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের যতটা সহযোগিতা করা যায়, তা করার আশ্বাস দেন তিনি। ব্যবসায়ীরা প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, ‘সামনে ঈদ। আগুনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করুন। নইলে পরিবারসহ তাদের রাস্তায় থাকতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের মার্কেটটি দাঁড় করিয়ে দিন।’ ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের সহযোগিতা করা হবে। এ বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। আপনাদের জন্য পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’

ডিএনসিসির কমিটি গঠন : গুলশান-১ কাঁচাবাজারে অগ্নিকান্ডের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ডিএনসিসি। এতে প্রধান প্রকৌশলী মো. জুবায়ের সালেহীনকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বিকালে অগ্নিকান্ডের ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকরা ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি ব্যবসায়ীদের বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমার পর এই মার্কেটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

ধানমন্ডিতে আবাসিক ভবনে আগুন : এদিকে গতকাল রাত ৮টা ২৪ মিনিটে রাজধানীর ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর সড়কের ৬৩ নম্বর বাসার দ্বিতীয়তলায় আগুন  লাগে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়ার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আগুন লাগার পরপরই মোহাম্মদপুর ফায়ার  স্টেশনের অপারেটর ফায়ারম্যান মো. রোমান জানান, সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে দুটি ইউনিট পাঠানো হয়। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে বাসাটিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই বাসার লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments